লেখিকা সাবাতিনি চ্যাটার্জী
মানবপাচার একবিংশ শতাব্দিতে এসে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান অনুসারে এটি “অনেকটা আধুনিক দিনের দাসত্ব” হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। মানব পাচারের সিংহভাগ তাই জোরপূর্বক শ্রম , আজীবন দাসত্ব, যৌন দাসত্ব বাণিজ্যিক যৌন শোষণ বা অঙ্গ উত্তোলন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে মানুষ ব্যবসা করছেন। এটি জঘন্যতম অপরাধ যা শুধু একটি দেশে সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। মানব পাচার আমাদের সমাজের জন্য মারাত্মক আক্রমানত্তক হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ এটি নির্দোষ নারী, শিশু এবং পুরুষদের তাদের স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে অমানবিক শোষণ করে। যাইহোক, একটি সত্য প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় সেটি হল মানব পাচারের অর্থনৈতিক দিক, যেমন, এই অপরাধী শিল্পের মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা। যত দিন যাচ্ছে মানবপাচার আরো বেশি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে কারণ মানুষের আর্থিক ও সামাজিক অসচ্ছলতা মানুষকে অপরাধমূলক কাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম এন্ড রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) ২০১৯ সালে প্রাইম ইন ইন্ডিয়া এর রিপোর্ট জারি করেছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সরকার আইপিসি অধীনে ২,০৮৮ টা মানব পাচারের মামলা করেছে , তুলনামূলকভাবে ২০১৮ সালে ১,৮৩০ টা মামলা আইপিসি ধারা অনুযায়ী নথিভূক্ত হয়েছিল এবং ২০১৭ সালে ২,৮৫৪ টা মানব পাচারের মামলা রিপোর্টে জারি করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সারা দেশে খুব কম মানব পাচারের ঘটনা রয়েছে যেখানে তদন্ত সংস্থাগুলি দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে তদন্ত পরিচালিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা করার পরিসংখ্যান টা একেবারে নগণ্য যার অন্যতম কারন মানুসের সচেতনতার অভাব।
২০১২ সালে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমএইচএ) প্রথমবারের মতো তার উপদেষ্টায় মানব পাচারকে একটি সংগঠিত অপরাধ বলে অভিহিত করে। এই পরামর্শের ধারা ৯.৭ এবং ৯.৯ রাজ্যগুলিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত আইনের অধীনে আর্থিক তদন্ত এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রিমিনাল সংগঠনগুলোর ক্রমবর্ধমান অপরাধের মধ্যে মানুষের পাচার অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। এই অপরাধ মানুষকে শোষণ এবং জবরদস্তির মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘন করে । (https://www.mha.gov.in/sites/default/files/advisory%20HT%20as%20organised%20crime %20on_0.pdf) এই প্রেক্ষাপটে প্রতিরোধ, যত্ন ও পুনর্বাসন বিল, ২০২১ (Prevention ,Care and Rehabilitation) , খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে প্রথমবার পুলিশের কর্মকর্তারা মানবপাচারের ক্ষেত্রে আর্থিক তদন্ত করার ক্ষমতা পেয়েছেন যাতে যথাযথ সংশোধন নিশ্চিত করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অধীনে অপরাধকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। 17 (4) এবং (5) ধারা আনুসারে তদন্ত কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেয় যে অভিযুক্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে পারে যদি সেগুলি পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং এর থেকে প্রাপ্ত অর্থ ভিকটিমের কাছে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের খরচ মেটাতে ব্যবহার করা যায়। 39 ধারা, পাচারের অপরাধের আয় থেকে সম্পত্তির মালিকানা, দখল এবং অধিগ্রহণ করে। এটি এই ধরনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার এবং সংযুক্ত করারও ব্যবস্থা করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে, সরকার সারা দেশের ১০,০০০ থানায় “নারী সহায়তা ডেস্ক” স্থাপনের জন্য অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন রুপি ($ ১.6.9 মিলিয়ন) বরাদ্দ করেছে ,মনে করা হচ্ছে ইহা নারী এবং শিশু পাচার কে অনেকটাই কমাতে সাহায্য করবে।পাচারবিরোধী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি রাজ্য আনুসারে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কিছু রাজ্য সরকার পাচার বিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালায় যেখানে, ” বন্ডেড শ্রমিক বিরোধী দিবস”,”মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস”, নারী ও শিশু সুরক্ষা ,মানুষের নৈতিক অধিকার ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে নাগরিকদের অবগত করা হয়।
প্রসঙ্গত ,৩০ শে জুলাই দিনটিকে মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং যারা মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তুলে নিয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা হয়। কোন ব্যক্তি কে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক সম্পন্ন যৌন শিকার করা চরম অপরাধ মূলক। এমন কি নারী ও শিশুদের শোষণ করা একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ। ৩০ শে জুলাই দিনটি কে পালন করা হয় মানুষকে সচেতন করার জন্য এবং মানব পাচারের ক্ষতি ও জীবনে এর প্রভাব বোঝানোর জন্য।
মানব পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবসের এবছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভিকটিমস’ ভয়েস পথ দেখায়। এটি মানাব পাচারের আক্রান্তদের মূল স্রোতে ফিরে আসা তাদের অস্তিত্ব সম্মান রক্ষার্থে তাদের অদম্য লড়াই এর কথা তুলে ধরে।এই অপরাধ নির্মূল করতে কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের শনাক্ত ও বাঁচাতে এবং তাদের পুনর্বাসনের পথে সহায়তা করে। তাই তাদের এই বেচে থাকার লড়াই মানব পাচারে আক্রান্তদের নতুন পথ দেখায়।আধুনিক দিনে মানব পাচারের এই দাসত্ব সুলভ আচরণ মানবসম্পদ কে নির্মমভাবে ধ্বংস করছে ।সর্বোপরি দেশের নাগরিকদের কাছে এটি চরম দুর্দশার একটি ঘটনা ,আশা করা যায় ভবিষ্যতে মানুষ এই বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং মানব সভ্যতার রক্ষা হবে। এই বর্তমান মহামারী পরিস্থিতির কারণে ভারতে পাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার খবরও রয়েছে ,এই উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায়, ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহিলা নিরাপত্তা বিভাগ জুলাই ২০২০ থেকে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে (ইউটি) নতুন মানব-পাচার বিরোধী ইউনিট (এএইচটিইউ) স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে একটি পরামর্শ জারি করেছে, যেখানে অবকাঠামো আপগ্রেড করার কথা বলা হয়েছে । ভারতে AHTU হল বিশেষ পুলিশ ইউনিট, যারা মানব পাচার মোকাবেলায় নিবেদিত। এমএইচএ পরামর্শের পরে, ১৬ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২২৫ এএইচটিইউ কেবল কাগজেই বিদ্যমান ছিল এবং এএইচটিইউগুলির মাত্র ২৭ শতাংশ চালু ছিল। এএইচটিইউ স্থাপনের চাহিদা বাড়ছে তাই মানব পাচার কমানোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।